মান্নান সৈয়দের গুরুত্ব

মান্নান সৈয়দের গুরুত্ব

শামসুজ্জামান খান | ৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ ৩:৫১ অপরাহ্ন
 
আবদুল মান্নান সৈয়দ আমার আর্দশগত বন্ধু ছিলে– এটা আমি বলব না। রাজনৈতিক চিন্তাধারায় তার সঙ্গে আমার অনেক দূরত্ব ছিল এবং সেই দূরত্ব বলতে গেলে মৌলিক। তবে আমি মান্নান সৈয়দকে দেথেছি একটা ভিন্নরকম প্রেক্ষাপটে। আমার মনে হয়েছে, তার রচনার দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে আমরা দেখব একটা ক্রমপরিবর্তিত রূপান্তর। লক্ষ্য করেছি তার মধ্যে চিন্তার একটা দ্রুত ও মৌলিক পরিবর্তন ঘটছিল। যে জায়গাটায় তিনি বিশ্বাস করতেন না সেই জায়গা থেকে তাকে আমরা একটু ভিন্ন অবস্থানে পরবর্তীকালে দেখেছি। যেমন লোকজ বিষয় নিয়ে তার কোনো আগ্রহ ছিল না প্রথমদিকে কিন্তু পরবতীকালে আমরা দেথেছি যে লালন ফকির নিয়ে তিনি যে একটি ছোট প্রবন্ধ লিখলেন তার গুরুত্ব কিন্তু অসামান্য। তিনি কেমন করে সে জায়গাটা থেকে সরে আসছিলেন এবং লালন যে একজন অসাধারণ বাণীসাধকও শুধুমাত্র একজন দার্শনিক নন, কেবলই একজন অসাধারণ লোক কবি নন, সঙ্গীতের একজন অসাধারণ স্রষ্টাও–এই বোধ তার মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল।
নিঃসঙ্গ ভুবনে হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদ [১৩ নভেম্বর ১৯৪৮-১৯ জুলাই ২০১২]

নিঃসঙ্গ ভুবনে হুমায়ূন আহমেদ

শিহাব সরকার

১৯৭২-এর মাঝামাঝি সময়ের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের অনার্সের ছাত্র আমি। পড়াশোনার পাশাপাশি আহমদ ছফা সম্পাদিত সাপ্তাহিক দাবানল-এ কাজ করি। ওখানেই আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। কাগজটি প্রথম বেরিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেরোতে থাকে ঢাকা থেকে। ওই সময়ের গাছপালা-ছাওয়া, ছায়ানিবিড় হাটখোলায় অফিস।
এক দুপুরে ছফা ভাই হন্তদন্ত হয়ে অফিসে ঢুকে লম্বালম্বি ভাঁজ করা এক তাড়া কাগজ আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘শিহাব, একটা দুর্দান্ত গল্প পেয়েছি। এখনই কম্পোজে দিয়ে দাও। আগামী সপ্তাহে যাবে। তুমি দেখার পর আমি আরেকবার প্রুফ দেখব।’ ছফা ভাই কাগজটা আমার টেবিলে রেখে চলে গেলেন তাঁর রুমে। আমার তর সইছিল না। তিনি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি গোটা গোটা অক্ষরে ফাউন্টেন পেনের কালো কালিতে লেখা গল্পটি পড়তে শুরু করি। লেখকের নাম হুমায়ূন আহমেদ। নামটি কি চেনাচেনা? গল্পের প্রথম লাইন, ‘এক সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি দেখলাম আমি কাফকার পোকা হয়ে গেছি।’ এরপর নানা অ্যাবসার্ড ঘটনা ও ফ্যান্টাসির ভেতর দিয়ে কাহিনি এগিয়ে চলে। এক বিমূর্ত পরিস্থিতিতে গল্প শেষ হয়। নন্দিত নরকে পড়ি আমি আরও দুই বছর পর। এক নিম্নমধ্যবিত্ত শহুরে পরিবারের গল্প সেটি। মর্মস্পর্শী একরৈখিক গল্প। অ্যাবসার্ডিটির লেশমাত্র নেই। হুমায়ূন আহমেদ আহমেদের অধিকাংশ উপন্যাস এই চরিত্রের। অথচ তাঁর সাহিত্যজীবনের শুরুতে লেখা একটি গল্প পুরোপুরি বিমূর্ত। তিনি প্রচুর আধিভৌতিক ও রহস্যালু গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। সায়েন্স ফিকশন ধরনের কাহিনিও তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল। ১৯৭২ সালে ফ্রানৎস কাফকার ছায়াশ্রিত দাবানল-এর লেখাটির কথা মনে করে আমি আজও বিস্মিত হই।

হুমায়ূন আহমেদের চেহলাম

জননন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের চেহলাম অনুষ্ঠিত হলো গতকাল মঙ্গলবার। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে ঢাকায় বনানী ডিওএইচএস কমিউনিটি সেন্টারে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় এ উপলক্ষে দোয়া ও স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। এ ছাড়া গাজীপুরের নুহাশপল্লীতেও সকাল থেকে কোরআন খতম, কবর জিয়ারত ও এতিমদের খাওয়ানো হয়।
ডিওএইচএস কমিউনিটি সেন্টারে
বনানীর ডিওএইচএস কমিউনিটি সেন্টারে দিনভর কোরআন খতম করা হয়। সন্ধ্যায় মিলাদ মাহফিলে তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। এরপর শুরু হয় স্মরণসভা। এতে হুমায়ূন আহমেদের কাজের মূল্যায়ন ও তাঁর সঙ্গে নানা মুহূর্তের স্মৃতিচারণা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ার হোসেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী ও গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম, জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ, হামিদুল হোসেন বীর বিক্রম, কামরুল হাসান, অভিনেতা আবদুল কাদের, শমী কায়সার, হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের পক্ষে ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তাঁর স্ত্রী ইয়াসমীন হক, বোন সুফিয়া হায়দার ও ছেলে নুহাশ হুমায়ূন। উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, জোহরা তাজউদ্দীন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারসহ হুমায়ূনের মা রাজিয়া ফয়েজ, ছোট ভাই আহসান হাবীব, তিন মেয়ে নোভা, শীলা, বিপাশা ও তাঁদের মা গুলতেকিন খানসহ পরিবারের সদস্যরা। অনুষ্ঠানের মাঝ পর্যায়ে রাত পৌনে আটটার দিকে হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, তাঁর বাবা মোহাম্মদ আলী, মা তহুরা আলী, দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিতকে নিয়ে চেহলাম অনুষ্ঠানে আসেন।
নুহাশপল্লীতে
‘নাম হলো তোমার হুমায়ূন/ গভীর নিদ্রায় আছো শয়ন/ নুহাশপল্লীর মির্জাপুর ইউনিয়ন/ তোমার স্মৃতি মনে করে/ ঝরে মোদের চোখের জল/ বাংলা তোমাকে রাখবে মনে/ চন্দ্র সূর্য যতদিন থাকে অবিকল।’
নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণ করে কেন এক অনুরাগী এই কবিতা লিখে টানিয়ে দিয়েছেন নুহাশপল্লীর একটি গাছে। নুহাশপল্লীতেই চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন সবার প্রিয় লেখক। গতকাল মঙ্গলবার তাঁর চেহলামে এ উপলক্ষে সকাল থেকেই সাধারণ মানুষ নুহাশপল্লীতে আসতে শুরু করেন।

অন্তরঙ্গ অবলোকন পূরবী বসু

হুমায়ূন আহমেদ স্মরণ

অন্তরঙ্গ অবলোকন-পূরবী বসু

এবার তার নিজের বাসায় নিউ ইয়র্কের জামাইকাতে এবং আমাদের ডেনভারের বাসায় গত ফেব্রুয়ারিতে বেড়াতে এলে হুমায়ূনকে একাধিকবার শয়ন ঘরের নিভৃতিতে নামাজ পড়তে দেখেছি। কিন্তু যতদূর মনে হয়, প্রতিদিন নিয়মিত পাঁচবার করে নামাজ তিনি পড়তেন না। অসুখের সময়টি ছাড়া ধর্মের ব্যাপারে তার মনোভাব কী ছিল কখনো জানার সুযোগ হয়নি। তবে লক্ষ্য করেছি, হাসপাতালে তার গলায় সার্বক্ষণিকভাবে লকেট দেওয়া হারের মতো একটা কিছু পরানো থাকতো, যার ধাতব লকেটের ভেতর আয়াতুল কুরসি লেখা রয়েছে।

যখন-ই ভাবি, মনে হয়, বাংলা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ আসলেই এক জীবন্ত কিংবদন্তী। হুমায়ূনের সৃজনশীলতার ব্যাপ্তি ও বিন্যাস, এবং এর বিভিন্ন স্তরে তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ
ও অবস্থানের কথা চন্তা করলে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। গল্প-উপন্যাস-নাটক-চলচ্চিত্রে সফল ও সিদ্ধহস্ত হুমায়ূন সংগীতের প্রতিও, বিশেষ করে আমাদের ঐতিহ্যবাহী লোকজ সংগীতের প্রতি, অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে পড়েন। সুযোগ পেলেই নাটকে, চলচ্চিত্রে, উপন্যাসে, এমন কি তার দৈনন্দিনের ঘটনা নিয়ে রচিত কলামেও সে ধরনের গানের কথা ঢুকিয়ে দিতেন। নিজে গান না গাইলেও গান শোনা, গান বোঝার মতো সজাগ ও পরিশীলিত কান ও মন তার ছিল।

কথা ছিল এবার নিউ ইয়র্কের বাৎসরিক বই মেলায় শুধুমাত্র এই দম্পতি হাজার বছরের বাংলা গানের ওপর একটি প্রামাণ্যগীতির অনুষ্ঠান পরিবেশন করবেন যেখানে ধারাবাহিকভাবে গান ও ধারা বর্ণনা দিয়ে এক ঘন্টার একটা মঞ্চ উপস্থাপনা হবে। পরিচালনা ও ধারা বর্ণনা করেবেন হুমায়ূন আর গান গাইবেন শাওন। আর এটি হবার কথা ছিল মূল মঞ্চে ৩০ জুন সন্ধ্যায় - অনুষ্ঠানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বাঞ্ছিত ‘প্রাইম টাইমে’। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেদিন সেসময় হুমায়ূন ছিলেন হাসপাতালের ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে শায়িত। শুধু গানের অনুষ্ঠান নয়, সেদিন বিকেলে-ই তাঁর অঙ্কিত চিত্রের প্রথম প্রদর্শনী হবারও কথা ছিল বইমেলাতে। হুমায়ূন সুযোগ পেলেই ছবি আঁকতেন। বেশিরভাগ ছবিই ল্যান্ডস্কেপ। দু’একটি পোর্ট্রেট। বিমূর্ত ছবি খুব একটা নেই। ছবি আঁকার প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহ ও কৌতূহল ছিল হুমায়ূনের বরাবই-ই। আর ছিল রঙের বিন্যাসের প্রতি তার তীক্ষ্ম নজর ও গভীর উপলব্ধি। হুমায়ুনের ইচ্ছা ছিল তার পাঁচ বছরের পুত্র নিষাদ এই চিত্র-প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবে এখানে। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন ছবি যদি কিছু বিক্রি হয়, সম্পূর্ণ টাকাই দিয়ে দেবেন তার নিজের দেওয়া স্কুলটিতে, যার স্থপতি ছিলেন শাওন, এবং যার আর্থিক অবস্থা খুব ভালো নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন বিশেষ কারণে তিনি তার চিত্রকলা বিক্রির পরিকল্পনা বাদ দিয়েছিলেন এবং বিদেশে তাঁর এই ছবিগুলোকে কেবল প্রদর্শনের জন্যেই টানাতে অনুমতি দেন, বিক্রয়ের জন্যে নয়। এছাড়াও, সেদিন-ই, ৩০ জুন শনিবার রাতেই, মুক্তধারার বইমেলার পক্ষ থেকে হুমায়ূনকে সম্মাননা দেবারও কথা ছিল সাহিত্য-শিল্পে তাঁর অসামান্য এবং সামগ্রিক অবদানের জন্যে। হুমায়ূনের হাতে সেই সম্মাননা তুলে দেবার কথা ছিল আমার। বলাবাহুল্য সেটাও আর ঘটে ওঠেনি। হুমায়ূন তখন গুরুতর অসুস্থ বেলভিউর আইসিইউ ইউনিটে। আর আমরা কয়েকজন ছিলাম তার পাশে।

বৃক্ষছায়ায় চিরনিদ্রায় হুমায়ূন

যে স্থানটি ছিল তার নিজের ‘জীবনের চেয়েও’ প্রিয় সেই নুহাশ পল্লীতেই সমাহিত হলেন নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ।

দূর-দূরান্ত থেকে হুমায়ূনের এই বাগানবাড়িতে এসে অশ্রুজলে লেখককে শেষ বিদায় জানালেন ভক্ত-পাঠক, বন্ধু-স্বজন ও স্থানীয় বাসিন্দাসহ হাজারো মানুষ। আকাশও যেন বৃষ্টি ঝরালো তারই শোকে।
যাদের কাঁধে চেপে খাটিয়ায় শোয়া হুমায়ূন কবরে নামেন, তাদের একেবারে সামনে দেখা গেল লেখকের বড় ছেলে নুহাশকে। তার পরনের নীল পাঞ্জাবীও বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল একেবারে।
 

‹ First  < 3 4 5