মান্নান সৈয়দের গুরুত্ব

মান্নান সৈয়দের গুরুত্ব

শামসুজ্জামান খান | ৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ ৩:৫১ অপরাহ্ন

আবদুল মান্নান সৈয়দ আমার আর্দশগত বন্ধু ছিলে– এটা আমি বলব না। রাজনৈতিক চিন্তাধারায় তার সঙ্গে আমার অনেক দূরত্ব ছিল এবং সেই দূরত্ব বলতে গেলে মৌলিক। তবে আমি মান্নান সৈয়দকে দেথেছি একটা ভিন্নরকম প্রেক্ষাপটে। আমার মনে হয়েছে, তার রচনার দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে আমরা দেখব একটা ক্রমপরিবর্তিত রূপান্তর। লক্ষ্য করেছি তার মধ্যে চিন্তার একটা দ্রুত ও মৌলিক পরিবর্তন ঘটছিল। যে জায়গাটায় তিনি বিশ্বাস করতেন না সেই জায়গা থেকে তাকে আমরা একটু ভিন্ন অবস্থানে পরবর্তীকালে দেখেছি। যেমন লোকজ বিষয় নিয়ে তার কোনো আগ্রহ ছিল না প্রথমদিকে কিন্তু পরবতীকালে আমরা দেথেছি যে লালন ফকির নিয়ে তিনি যে একটি ছোট প্রবন্ধ লিখলেন তার গুরুত্ব কিন্তু অসামান্য। তিনি কেমন করে সে জায়গাটা থেকে সরে আসছিলেন এবং লালন যে একজন অসাধারণ বাণীসাধকও শুধুমাত্র একজন দার্শনিক নন, কেবলই একজন অসাধারণ লোক কবি নন, সঙ্গীতের একজন অসাধারণ স্রষ্টাও–এই বোধ তার মধ্যে জাগ্রত হয়েছিল।

তিনি সেই ছোট প্রবন্ধে যতদূর মনে পড়ে মান্নানের সর্বশেষ প্রবন্ধের বই ঈশ্বরগুপ্ত থেকে শহীদ কাদরী সেইখানে লালনের উপর লেখা এই প্রবন্ধটাও আছে ‘লালন ফকির’ নামে। তার মানে আমাদের সামগ্রিক বাংলা কবিতায় লালন ফকিরের যে গুরুত্ব ও মর্যাদা আছে সেটাও কিন্তু মান্নান উল্লেখ করেছেন। এটা আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। আবার যদি আমাদের বর্তমান সাহিত্য বা মূল সাহিত্যের দিকে দেখি তাহলেও দেখব সেখানেও তার চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটছে। একসময় মার্ক্সবাদকে তিনি একেবারে সহ্যই করতে পারত না। এ সর্ম্পকে তার কোনো আগ্রহই ছিল না। এবং সাহিত্যের যে একটি সামাজিক দায় থাকে সেটিও মান্নান সৈয়দ কখনোই গুরুত্বের মধ্যে মানতেন না। কিন্তু পরবতীকালে সেই জায়গা থেকে তার চমৎকার একটা পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করতে পারি। আমরা দেখেছি যে তিনি রণেশ দাশগুপ্তর উপর যে প্রবন্ধ লিখেছেন তা শুধু শ্রদ্ধামিশ্রিত একটি সর্ম্পকের উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠেনি,কিংরা কেবল তার নতুন রূপান্তরমূলক চিন্তাকেই বিন্যস্ত করছেন না বরং রণেশ দাশগুপ্তের সাহিত্যচিন্তার মধ্য যে মৌলিকতা আছে, যে অসাধরণত্ব আছে সেটাকেও তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গেই দেখছেন। এটিও খুব সামান্য একটি ব্যাপার নয়। ঠিক তেমনিভাবে কবিতার ক্ষেত্রে তিনি আমাদের যে তরুণ বিদ্রোহী সুকান্ত, সুকান্ত ভট্টাচার্য্ সম্পর্কেও তার যে বিশ্লেষণ ওখানে আছে সেটিও আমাদেরকে মুগ্ধ ও উদ্বুদ্ধ করে।

একটি সামগ্রিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে আমাদের সাহিত্যকে তিনি যে জায়গায় দেখছেন সেটাকে আমি বলব একেবারেই বস্তুনিষ্ঠ, মৌলিক এবং প্রকৃত মূল্যায়ন। এই জায়গায় মান্নান সৈয়দ নিজেকে পরিবর্তিত করে নিয়ে এসেছিলেন এবং এটি আমাকে সবসময় আকৃষ্ট করেছিল অথবা বলা যায় আমাদের বন্ধুত্বের ব্যাক্তিগত পর্যায়ের মধ্যে প্রথম দিকে রাজনৈতিক যে একটু টানাপড়েন ছিল সেই জায়গাটা ধীরে ধীরে অপসৃত হচ্ছিল তার এ লালন মূল্যায়নে, তার রণেশ দাশগুপ্তের মূল্যায়নে, তার সুকান্তের মূল্যায়নে এবং সাহিত্যের সামগ্রিক মূল্যায়নেও বটে। তারপর নজরুল নিয়ে তিনি যখন কাজ করেছেন তখন আমি অনেকটাই তার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। বিশেষ করে তার নজরুল ইসলামকে নিয়ে যে মূল্যায়ন– তিনি যে কবি, কালজ এবং একই সঙ্গে কালোত্তর– এটাও কিন্তু ওই লালন, সুকান্ত ও রণেশ দাশগুপ্তের মুল্যায়নের সঙ্গে প্রায় মিলে যায়। নজরুলের কবিতার মধ্যে সামাজিক দায়ের ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, সেই জায়গাটাকে তিনি যেভাবে মূল্যায়ন করছেন সেটাও আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তার ওই বইটি যখন ছাপা হয় আমি তখন বাংলা একাডেমীর একজন পরিচালক। ওই বই ছাপার দায়িত্ব ছিলো আমার। আবু হেনা মোস্তফা কামাল সাহেব তখন ছিলেন এখানকার মহাপরিচালক। তিনি বললেন শামসুজ্জামান, কালকে নজরুলের উপর অনুষ্ঠান আমাদের বাংলা একাডেমীতে, আমি চাই মান্নানের এই বইটা আপনারা ওইদিন একদম পরিপূর্ণ্ ছাপা অবস্থায় আমার হাতে দিবেন। তো মান্নান সৈয়দ, আমি এবং তৎকালীন প্রেস ম্যানেজার ওবায়দুল ইসলাম–আমরা মিলে সারা রাত জেগে অত্যন্ত আনন্দ ও উল্লাসের মধ্যে এবং একই সাথে কঠিন পরিশ্রম যুক্ত করে আমরা বইটি প্রকাশ করে ফেললাম। আর সেটি যে কত আনন্দের একটা বিষয় হয়েছিল সেদিন সেটি বলা সম্ভব না।

মান্নানের গদ্যভঙ্গি আমাকে আকৃষ্ট করত। তার শব্দ ব্যবহারে যে নতুনত্ব ছিল, উদ্ভাবনময়তা ছিল… একটা শব্দকে সে নতুন করে নতুন ব্যঞ্জনায় একবারে আমাদের সামনে নিয়ে আসতে পারতেন। এটা আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করত। আমি তো তার সাথে নিয়মিত আড্ডা দিতাম। আমাদের পাঠক সমাবেশের স্বত্তাধিকারী শাহিদুল ইসলাম বিজু, তার তিনতলার ওপরের ঘরটি আমাদের জন্য ছেড়ে দেয়া ছিল এবং ওখানে একটি চেয়ার ছিল যে চেয়ারটায় মান্নান সৈয়দ বসতেন, বলতেন এটা আমার জন্য। তারপরে তার মুখোমুখি বসতাম আমি আর কিছু তরুণ ছেলে তখন থাকত। বিজু আমাদের জন্য চমৎকার খাবারের ব্যবস্থা করত এবং ওখানকার যে চিনি ছাড়া লাল চা তার আকর্ষণও ছিল অসাধারণ। আমরা নিয়মিত ওইখানে আড্ডা দিয়েছি। তো এই হল একটা দিক আর আরেকটা দিকের কথা খুবই গুরুত্বপূণ, সেটা হল যে আমি মনে করি মান্নান সৈয়দের মৃত্যুতে আমাদের সাহিত্যের যে ক্ষতি হয়েছে, শুধু আমাদের সাহিত্যের না গোটা বাংলা সাহিত্যের যে ক্ষতি হয়েছে সেটি প্রকৃত অর্থেই অপূরনীয়। আমরা বলি বটে অনেকের মৃত্যুর পর যে তার মৃত্যু অপূরনীয় ক্ষতি, সহজে পূরণ হবে না–এটা আমরা বলি বটে কিন্তু সেটা অনেক সময় একটা কথার কথা হয়ে যায়। কিন্তু মান্নানের ক্ষেত্রে এটি একেবারেই সত্য। তার কারণ বাংলাসাহিত্যে, বিশেষ করে এখন তো বাংলা দুই ভাগে বিভক্ত, একদিকে পশ্চিমবাংলা আর অন্যদিকে আমাদের বাংলাদেশ। অবশ্য বাংলা আরও অন্য অঞ্চলেও আছে, ত্রিপুরায় বাঙ্গালী আছে, আসামে বাঙ্গালী আছে আরও কোনো কোনো জায়গায় এখন বাঙ্গালী আছে। কিন্তু সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের দিক থেকেই মান্নান সৈয়দের মৃত্যু অপূরণীয় ক্ষতি। তার কারণ এই দুই বঙ্গেরই বা এই বঙ্গ অঞ্চলে সাহিত্য নিয়ে প্রকৃত বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা লেখার জন্যে বা ইতিহাস তৈরি করার জন্য মান্নান সৈয়দের বিকল্প আমি দেখি না। তার কারণ হল পশ্চিম বঙ্গে যারা সমালোচক আছেন তারা বাংলাদেশের প্রায় কোনো সাহিত্যিক সম্পর্কেই কিছু জানেন না। মূল্যায়নতো দূরের কথা। আর বিস্তারিতভাবে না জানলে কোনো বিষয়ের ইতিহাস লেখা যায় না, এমনকি ভালো আলোচনাও লেখা যায় না। মান্নান সৈয়দের একটা গুণ ছিল যে তিনি পশ্চিম বঙ্গের সকল লেখক সর্ম্পকে জানতেন। তাদের সকল প্রধান লেখকের রচনাই তিনি গুরুত্বের সঙ্গে পাঠ করতেন এবং বাংলাদেশের সকল লেখকদের লেখাও তিনি পাঠ করতেন। তার ফলে বাংলা সাহিত্যের যে কোনো লেখক সম্পর্কে, সমকালীন লেখক সম্পর্কেও একমাত্র বস্তনিষ্ঠ, তথ্যনিষ্ঠ আলোচনার লোকটি ছিলেন মান্নান সৈয়দ, ইতিহাস লেখার লোকটি ছিলেন মান্নান সৈয়দ। সেরকম আর কেউ এখন নাই। যার ফলে তার মৃত্যুতে যে অপূরণীয শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে সেটি কখনোই পূরণ হবার নয়। ওই বাংলার কেউ কায়কোবাদ সর্ম্পকে একটি পূর্ণাঙ্গ রচনা লিখতে পারবে না। ওই বাংলায় কেউ মীর মোশাররফ হোসেন সর্ম্পকে একটা ভালো আলোচনা লিখতে পারবে না। ওই বাংলার কেউ নজিবুর রহমান, আমাদের যে প্রথম দিকের ঔপন্যাসিক তার সর্ম্পকে লিখতে পারবে না। কিন্তু মান্নান সৈয়দ পশ্চিমবঙ্গের শুধুমাত্র মুখ্য লেখকই নয় অনেক গৌণ লেখক সম্পর্কেও লেখার ক্ষমতা রাখতেন। এই জায়গাটায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। অর্থাৎ তার মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের, সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যের যে ক্ষতি হয়েছে তা অসামান্য। এই জন্য মান্নানের মৃত্যু আমার জন্য এক চরম হূদয়গত রক্তক্ষরণের ব্যাপার। আমাদের এখানে সাহিত্য বিবেচনার ক্ষেত্রে এক ধরনের, কী বলব, দলীয় দৃষ্টিকোন বলতে চাই না, গোষ্ঠীগত একধরণের মূল্যায়ন হয়ত আছে। যে কারনে মান্নান সৈয়দকে অনেকেই পছন্দ করত না তার রাজনৈতিক বিবেচনার জন্য।

তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনারও যে রূপান্তর হচ্ছিল সেটা তো ইতিবাচক, সেটা তো সামগ্রিকতার দিকে তার নতুন করে যাত্রা। অর্থাৎ সেই জায়গায় মান্নান সৈয়দকে ভুল বোঝা বা তাকে একপাশে করে দূরে সরিয়ে রাখা তাদের খুব ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তার মৃত্যুর পর বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে কেন নাগরিক শোকসভা আমি করতে যাচ্ছি সেজন্য আমাদের সমকালীন অনেক গুরুত্বপূর্ণ্ কবির কাছ থেকে অভিযোগ শুনতে হয়েছে। সেটি আমার হূদয়ে হয়ত পীড়ার কারন হয়েছে কিন্তু তাদের কথা আমি শুনি নি। আমার যে সাহিত্য বোধ আমার যে সাহিত্য বিবেচনা সেখান থেকেই আমি মান্নান সৈয়দের উপরে বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে একটি নাগরিক শোকসভা করেছিলাম এবং আমি মনে করি যে ইতিহাস একদিন বিচার করবে আমি যথাযোগ্য কাজটিই করেছিলাম। সূত্র (bdnews24.com)