নিঃসঙ্গ ভুবনে হুমায়ূন আহমেদ

১৯৭২-এর মাঝামাঝি সময়ের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের অনার্সের ছাত্র আমি। পড়াশোনার পাশাপাশি আহমদ ছফা সম্পাদিত সাপ্তাহিক দাবানল-এ কাজ করি। ওখানেই আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। কাগজটি প্রথম বেরিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেরোতে থাকে ঢাকা থেকে। ওই সময়ের গাছপালা-ছাওয়া, ছায়ানিবিড় হাটখোলায় অফিস।
এক দুপুরে ছফা ভাই হন্তদন্ত হয়ে অফিসে ঢুকে লম্বালম্বি ভাঁজ করা এক তাড়া কাগজ আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘শিহাব, একটা দুর্দান্ত গল্প পেয়েছি। এখনই কম্পোজে দিয়ে দাও। আগামী সপ্তাহে যাবে। তুমি দেখার পর আমি আরেকবার প্রুফ দেখব।’ ছফা ভাই কাগজটা আমার টেবিলে রেখে চলে গেলেন তাঁর রুমে। আমার তর সইছিল না। তিনি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি গোটা গোটা অক্ষরে ফাউন্টেন পেনের কালো কালিতে লেখা গল্পটি পড়তে শুরু করি। লেখকের নাম হুমায়ূন আহমেদ। নামটি কি চেনাচেনা? গল্পের প্রথম লাইন, ‘এক সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি দেখলাম আমি কাফকার পোকা হয়ে গেছি।’ এরপর নানা অ্যাবসার্ড ঘটনা ও ফ্যান্টাসির ভেতর দিয়ে কাহিনি এগিয়ে চলে। এক বিমূর্ত পরিস্থিতিতে গল্প শেষ হয়। নন্দিত নরকে পড়ি আমি আরও দুই বছর পর। এক নিম্নমধ্যবিত্ত শহুরে পরিবারের গল্প সেটি। মর্মস্পর্শী একরৈখিক গল্প। অ্যাবসার্ডিটির লেশমাত্র নেই। হুমায়ূন আহমেদ আহমেদের অধিকাংশ উপন্যাস এই চরিত্রের। অথচ তাঁর সাহিত্যজীবনের শুরুতে লেখা একটি গল্প পুরোপুরি বিমূর্ত। তিনি প্রচুর আধিভৌতিক ও রহস্যালু গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। সায়েন্স ফিকশন ধরনের কাহিনিও তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল। ১৯৭২ সালে ফ্রানৎস কাফকার ছায়াশ্রিত দাবানল-এর লেখাটির কথা মনে করে আমি আজও বিস্মিত হই।
বই, বিশেষ করে গল্প-উপন্যাস পড়ার ব্যাপারে আমার দারুণ বাছবিচার। কলেজে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষেই আমার পড়া হয়ে গেছে বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদি উপন্যাসগুলো। স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়েছি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর প্রমুখের গল্প—সেই সঙ্গে গল্পগুচ্ছ। পাঠের রুচি আমার তৈরি হয়েই ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে পড়ার সুবাদে নিজেকে আবিষ্কার করলাম বিশ্বসাহিত্য ভান্ডারের এক রোমাঞ্চকর দরজার সামনে। এসব কারণে হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় ও ভীষণভাবে পাঠকনন্দিত উপন্যাসগুলো সম্পর্কে আমার এক ধরনের অনীহাই ছিল। মূলত কবিতা এবং মাঝেমধ্যে গল্প-উপন্যাস রচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল আমার সাহিত্য-তৎপরতা। বহু বছর বাদে বিয়ে এবং সংসার শুরু করার পর স্কুল-কলেজপড়ুয়া দুই সন্তানের হাত ধরে আমার কাছে তখনো অজানা হুমায়ূনের ঘোর-লাগানো জগৎ, যা পরবর্তী বছরগুলোয় গাঢ় হতে থাকে। আমার ছেলেমেয়ে দুজনই বইয়ের পোকা। তারা একসঙ্গে অবলীলায় পড়ে যায় হুমায়ূন ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আর আমি রাতে বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়ার পর টিভির রিমোট টিপতে টিপতে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে ওদের টেবিল থেকে নিয়ে আসি হুমায়ূন আহমেদের বৃহন্নলা বা তিথির নীল তোয়ালে অথবা ভৌতিক অমনিবাস।
হুমায়ূন নিজেই বিভিন্ন সময় বলেছেন, তিনি সিরিয়াস সাহিত্য করতে নামেননি। বুদ্ধদেব বসু আজ থেকে ৭০-৮০ বছর আগে বলেছিলেন, ‘চাই আনন্দের সাহিত্য।’ কিছুটা ভিন্ন অর্থে হুমায়ূন তাঁর লাখো পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন সেই আনন্দে আর্দ্র সাহিত্য। এ সাহিত্য কেবল পাঠের জন্য, গ্রন্থবিশেষের গভীরে ডুবে গিয়ে ক্ষণস্থায়ী মণিমানিক্য বা অমিয় সুধা আহরণের জন্য, পাঠ-পরবর্তী ভারী তর্ক-বিতর্ক অথবা ডিসকোর্সের জন্য নয়। সন্তানদের হাত থেকে হুমায়ূনের এ-বই সে-বই পড়তে পড়তে আমি একদিন আবিষ্কার করলাম, আমার টেবিলে মার্কেজের লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা বা হান্টিংটনের ক্ল্যাসেজ অব সিভিলাইজেশনস-এর পাশাপাশি বুকমার্কার দেওয়া হুমায়ূনের জননী ও জ্যোৎস্নার গল্প। আমার কথা শুনে অনেক উঁচকপালি পাঠক ভ্রু কুঁচকাতে পারেন। বলতে পারেন, পাঠক হিসেবে আমার এখনো পরিপক্কতা আসেনি। কিন্তু আমি নাচার। আমি স্কুলজীবনে কড়ি দিয়ে কিনলাম ও নীহার গুপ্তের কালোভ্রমর পড়েছি রুদ্ধশ্বাসে। হুমায়ূন আহমেদের চৌম্বক শক্তি এড়ানোর সাধ্য আমার নেই। তাঁর ‘গল্প’ বলার সরল ভঙ্গি, কাহিনির বুনন ও চরিত্র বানানোর শৈলী আমাকে টানে; আমি মোহিত হয়ে থাকি তাঁর সেন্স অব হিউমার বা রসবোধে। নিত্যদিনের জীবন থেকে কী জাদুকরি পারদর্শিতার সঙ্গেই না তিনি মানুষের আনন্দ-বেদনার কাব্যকণা তুলে এনেছেন। অনেকে বলে, তিনি কেবল নাগরিক জীবনের কথা বলেছেন, কিন্তু তাঁর অনেক বইয়ের পটভূমি পুরোপুরি গ্রাম। অন্যদিকে, ধুলো-কাদার বাস্তবের অতীত অতীন্দ্রিয় ও ব্যাখ্যাতীত জগৎ নিয়ে লেখা তাঁর গল্প-উপন্যাসগুলো ছেলে-বুড়োনির্বিশেষ সব পাঠককে টানে। আসলে এসব বই পড়ার জন্য বিশেষ ধরনের ‘মন’ থাকা চাই, যে মন থাকবে চিরসজীব। দেখে ভালো লাগে যে এ ধরনের সম্মোহিত পাঠক আমাদের সমাজে এখনো প্রচুর আছে, বর্তমান আইসিটি যুগের অজস্র সোশ্যাল মিডিয়াকেন্দ্রিক চিত্তহারী বিনোদন সত্ত্বেও।
কোনটা ধ্রুপদ বা কালজয়ী সাহিত্য, কোনটা সময়ের পরীক্ষায় ফিকে হয়ে যাবে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে বরাবর। এর পরও কিছু কাজ সমসময়কে অতিক্রম করে সহস্রাধিক বছর টিকে গেছে। যেমন—গ্রিক, ল্যাটিন বা সংস্কৃত এপিক, শেক্সপিয়ারের নাটক এবং অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে রচিত অজস্র কবিতা ও গদ্যকর্ম। এ তালিকায় অবশ্যই আছেন রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে, টমাস মান, টি এস এলিয়ট, সার্ত্রে, কামু-কাফকাসহ বিভিন্ন দেশের অগুনতি লেখক। জীবদ্দশায় তাঁদের প্রত্যেকের ভবিতব্যই ছিল অনিশ্চিত, অস্পষ্ট। বাংলা সাহিত্যের প্রসঙ্গে আসি। তুমুল জনপ্রিয়তা এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র কর্তৃক জাতীয় কবির স্বীকৃতি পাওয়ার ফলে কাজী নজরুলের স্থান মহাকালের পাতায় খোদিত হয়ে গেছে। একই সঙ্গে জীবনানন্দ দাশ জীবনভর অনুজ্জ্বল থাকলেও মৃত্যুর পর উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছেন। এ রকম দৃষ্টান্ত বিশ্ব ইতিহাসে প্রচুর। আসলে ক্ষণস্থায়িত্ব বা অমরতার হিসাব বেশ জটিল। মনে হয়, কোনো নেপথ্য শক্তি অত্যন্ত নিরাসক্তির সঙ্গে এটা নির্ধারণ করে দেয়।
কখনো লেখক যদি তাঁর মেধা এবং বহুমুখী সৃজনশীলতা দিয়ে তাঁর সময়েই আকাশচুম্বী পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেন, তা মন্দ কিছু নয়। কিটস, বায়রন, শেলি, ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রমুখ ইংরেজ রোমান্টিক কবি তাঁদের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন এবং এখনো আছেন। একই কথা খাটে আমেরিকান কবি হুইটম্যানের ক্ষেত্রে। হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে এখনই কোনো মন্তব্য করা বোধ হয় সমীচীন হবে না। অনেকে অবশ্য বলতে শুরু করেছেন, ২০-২৫ বা ৩০ বছর পর তাঁর পরিণতি হবে নীহাররঞ্জন গুপ্ত বা বিমল মিত্রের মতো। এটা বলার সময় আমরা ভুলে যাই, হুমায়ূন ছিলেন আপাদমস্তক শিল্পে নিবেদিত একজন মানুষ। তিনি প্রচুর লিখেছেন। কারণ, সাহিত্য ছিল তাঁর জীবিকা। তাঁর তিন শরও বেশি বই থেকে এক বড় অংশ হয়তো পালপ-ফিকশন হিসেবে হারিয়ে যাবে। কিন্তু তাঁর বড় কাজগুলো এবং এর বিষয় ও রচনাশৈলী?
পৃথিবীর অনেক অনেক বড় মৃত ও জীবিত লেখকের মতো প্রচুর মেধা ক্ষয় করে এবং ঘাম ঝরিয়ে লেখেননি হুমায়ূন। তাঁর লেখার অন্যতম গুণ তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততা। লিখতে বসে তাঁকে গভীর ভাবনা বা চিন্তার জগতে ডুবে যেতে হয়নি। সৃজনশীলতায় টগবগে ছিল তাঁর মন, চোখের সামনে ভাসত বৈচিত্র্যময় জীবনের সারি সারি ছবি। এর সঙ্গে ঈর্ষণীয় এক সৃজনশীলতা যুক্ত হওয়ায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বহুলপ্রজ লেখক হয়ে উঠতে তাঁর সময় লাগেনি।
সাহিত্য পাঠ আমাদের নৈতিক শিক্ষা দেয় না। কিন্তু আমাদের অন্তর্লোককে পরিশীলিত করে বৈকি। হুমায়ূন বাঙালি তরুণ পাঠক-পাঠিকাদের চিন্তার নির্মলতায় দীক্ষিত করেছেন, বিশেষ কোনো উপন্যাস বা গল্পের বিষয়গত রূঢ় বাস্তবতা সত্ত্বেও। একই সঙ্গে তিনি আমাদের স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন, কল্পনাপ্রবণ করেছেন। শিখিয়েছেন, চারদিকের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ও পর্যবেক্ষণের যোগ্য। মূলত সাহিত্য এবং এর শাখা-প্রশাখা, টিভি নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদি মিলিয়ে হুমায়ূনের বিশাল সৃষ্টিসম্ভার। তাঁকে বাঙালি জীবনের এক ‘কালচারাল ফেনোমেনন’-এ পরিণত করেছে। হুমায়ূন আহমেদের চার দশকব্যাপী বিস্তৃত সৃষ্টিশীল অধ্যায় কাল কি পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারে? পরপারে চলে যাওয়ার পর তিনি এখন একা, পুরোপুরি নিঃসঙ্গ। তাঁকে ঘিরে নেই ভক্ত-পাঠকের দল। নেই তাঁর পাণ্ডুলিপি পাওয়ার জন্য প্রকাশকদের হুড়োহুড়ি। নেই পুলিশি পাহারায় বাংলা একাডেমীর একুশে বইমেলার কোনো ভক্তপিষ্ট স্টলে তাঁর বসে থাকার দৃশ্য। তিনি সম্পূর্ণ একা। এখন শুরু হবে তাঁর টিকে থাকা না-থাকার পরীক্ষা। সূত্র (প্রথমআলো)